যাবে না। সময়ের ব্যবধানে শোক কমে যায়, কিন্তু বেদনা কোনদিন মরে যায় না। তা অন্তরে জেগে থাকে। তাইতো দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধা কন্যার নিরাসক্ত ছবির নিষ্ঠুর বাস্তবতা এ কঠিন সত্যকে ধারণ করে বয়ে বেড়াচ্ছে সুদীপ্তা পাল শেলীর পিতা। পিতার হৃদয়ে কন্যার সজীব অস্তিত্ব অবিনাশী হয়ে আছে। দুঃখের পরিচয় যদি ভারাকান্ত পাথরের রূপ নেয় তবে দুঃখের ভেতর বেঁচে থাকার উৎস পাবে কোথায়; এই বাস্তবতার নিরিখে অন্তরের নিগূঢ় বেদনাবোধের হাহাকার শেলীর পিতার ভেতর প্রত্য করা যায়। শেলীর পিতা একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক। আজ অবধি আমি তাঁকে আমার জীবনের আদর্শ হিসাবে মেনে চলি। তাঁর চিন্তা-চেতনা, তাঁর সততা ও সহমর্মিতা, জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা আমাকে অনেক অনেক বেশী আলোড়িত করে। সেই শিকের সবগুলো গুনই ছিল শেলীর মধ্যে। শেলীর অবয়ব গঠন ঠিক দেবীর মতই ছিল। দুর্গা, কালী, সরস্বতী কারো থেকে কম ছিল না শেলী। কোন সাজ গোজ ফ্যাশনে বিশ্বাসী ছিলেন না। ঠিক যেন প্রকৃতির কন্যা। প্রকৃতির সংগে মিশে যেতেন। বিন্দুমাত্র অহংকার ছিলনা এই প্রকৃতির কন্যার মাঝে। নব্বই দশকে শেলী নেত্রকোণার একক তারকা মঞ্চ অভিনেত্রী ছিলেন। শেলী ‘সোনাই মাধব’ নাটকে সোনায়ের চরিত্র অভিনয়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ‘ইতিহাস কথা কও’, গুনাইবিবি নাটকে অভিনয় করেন। তাকে ছাড়া নেত্রকোণার কোন মঞ্চনাটক সম্ভব হতো না। এবার আরেকজনের কথা বলবো যাঁর সুরে বড় পুকুর পাড়ের পানি জলকেলি বয়ে যেত তিনি খাজা হায়দার হোসেন।
‘শোন গো রূপসী কন্যা গো
কার লাগিয়া গাঁথো ফুলের মালা।’
এই গানটি সন্ধ্যার পর বড় পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে গেলে শুনা যেত। মনে হতো যেন আব্দুল আলিমের কণ্ঠ। এছাড়াও তিনি জালাল
খাঁর “সে পাড়ে তোর বসত বাড়ীরে...।”, “কেহ করে বেঁচা কেনা
কেহ কান্দে...।” এবং রশিদ উদ্দিনের পীড়িতি করিয়া জনম ভরিয়া...। গানগুলো খুব দরদ দিয়ে গান গাইতে খাজা হায়দার হোসেন। ৯০ এর দশকের প্রথম দিকে নারী প্রগতির উদ্যাগে খাজা হায়দার হোসেন কলকাতাস্থ নেত্রকোণা
সমিতি আয়োজিত লোকজ সংগীত উৎসবে গানে গানে দর্শক
শ্রোতাদের মাতিয়ে প্রশংশিত হয়েছিলেন। এ ধারাবাহিকতায় ২০০০সালে
দিশারীর দুই দশক উৎযাপন উপলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উৎসবে উদীচীর
সাংস্কৃতিক দলের সাথে আসামের শিলচর সফর করেন। সম্পূর্ণ প্রচারবিমূখ, নিভৃতচারী ওই শিল্লী
দেশের বহু গুনি শিল্পীদের সাহাচর্যে সংগীতাঙ্গনে উৎসাহ অনুপ্রেরণা
পেয়েছেন। সংগীত নিয়ে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন।
২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর। একের পর এক বোমা ঘটনা
ছোট নেত্রকোণা শান্ত শহরের উপর বেদনার করুণ শোক বয়ে যায়। এক ভয়ঙ্কর আত্মঘাতি দানব ছোবল মেরে আমাদের সকলের কাছ থেকে সুরের যাদুকর খাজা হায়দার
ও বীনাপানি দেবী শেলীসহ ৮ জনকে নিয়ে যায়। লিখতে বসে কত কথা এবং
স্মৃতি ভেসে উঠে তা প্রকাশ করা সম্ভব না।
তাঁদের মৃত্যু হয়েছে সত্য। কিন্তু তাঁদের আদর্শের
মৃত্যু ঘটেনি,
যা তাঁরা লালন করেছেন জীবনের শেষ মুহুর্ত
পর্যন্ত। উদীচী সকল অন্যায়-অবিচার, কৃপমন্ডুকতা,
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এবং প্রগতির পে লড়াইয়ে
সবার আগে সোচ্চার হয়েছে। তাই অন্ধকারের শক্তি বারবার আঘাত হেনেছে উদীচীর উপর। স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে প্রগতির চাকা। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ
যশোরে দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা মেরে কেড়ে নিয়েছে ১০ জন শিল্পীকর্মীকে। নেত্রকোণাবাসীর দাবী- হায়দার, শেলী, যাদব সহ যাঁরা শহীদ এবং সিস্প্রটারে আঘাতে আহত হয়ে অর্ধমৃত্যু
জীবযাপন করছে তাঁদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক।
২০০৫ সালে ৮ ডিসেম্বর বোমা হামলায় আহত উদীচীর সদস্য সুব্রত রায়ের সঙ্গে আমার কথা
হয়, তিনি বলেন- “আজও আমরা জানতে পারলাম না কারা সেদিনের আত্মঘাতী হামলাকারীকে নেত্রকোণায় আশ্রয়
প্রশ্রয় দিয়েছিল?
তাদের শক্তি কি এতই বেশি যে, তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে? কি অপরাধ ছিল আমাদের? কি অপরাধ ছিল আমাদের বোন শেলীদি আর হায়দার ভাইয়ের? তারা দেশের কথা বলত, দেশের মানুষের কথা তথা বাঙ্গালী সংস্কৃতির কথা বলত, গান গাইত, এই কি ছিল তাঁদের অপরাধ? আমরা অনেক আশাবাদী ছিলাম আমরা যারা বোমায় আহত হয়ে অপূণীয় তিগ্রস্থ
হয়েছি এবং আজীবন এ যন্ত্রনা বয়ে যেতে হবে বর্তমান সরকার তাদের প্রতি একটু নজর দিবেন। কিন্তু বিষয়টি অপ্রিয় হলেও সত্য যে অধ্যাবদি পর্যন্ত সরকারে কোন মহল হতে আমাদের
প্রতি সাহায্যের কোন হাত বাড়ায়নি। অপরদিকে চিকিৎসা সাহায্যের জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে গেলেও কোন রকম সাহ্যয্য মেলেনি। প্রতি বছরের মতো আবারো ঘুরে এসেছে এই দিনটি। যা মনে করিয়ে দেয় আমাদের ভয়াল দিনটির কথা। এখনো গা শিহরে ওঠে। বর্তমান সরকার আমাদের আহত ও নিহতর পরিবারকে ক্ষতিপূরণে যথাযথ
সহযোগিতা প্রদান করবে এবং সেই সঙ্গে এদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিবদ্ধ
থাকবে-এটাই প্রত্যাশা করছি।”
বাংলা ভাই,
সাইখ আব্দুর রহমান সহ বেশ কিছু জঙ্গির ফাঁসি
কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে জাতি অনেকটা কলংকমুক্ত হলো। এখন একাত্তরের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। বাঙালি জাতিসত্ত্বায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসী প্রতিটা মানুষ চায়-ওই ঘৃণ্য
পশুদের বিচারের মাধ্যমে জাতি পুরোপুরি কলঙ্গমুক্ত হবে। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ওই বিচার প্রক্রিয়া
বানচালে। সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির প্রতীক জামায়াত-শিবির তথা জঙ্গীবাদ
আবারও দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চোরা গুপ্তা হামলা
চালাচ্ছে পুলিশের উপর। নিরীহ মানুষের যানমাল আজ বিপন্ন ওদের তান্ডবে। ওরা বিজয়ের মাসে হরতাল ডাকে, কার ইশারায়। এত সাহস পায় কোথায়? নেত্রকোণা উদীচী ট্র্যাজিডি
দিবসে তরুণ প্রজন্মের দৃঢ় বিশ্বাস-ওই অশুভ শক্তির পরাজয় এ বিজয়ের মাসেই হবে হবেই।
পোষ্ট : বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ১১ : ৫৪ মিনিট ০৭ ডিসেম্বর ১২।