কর্মকা-, শৈশবের শিক্ষা, যৌবনের মুক্তিযুদ্ধ সবই ওখানে। দিগন্তবিস্তৃত আকাশ, অবারিত মাঠ আর সমুদ্রসম মিষ্টি পানির এমন দৃশ্য আমি দুনিয়ার আর কোথাও দেখিনি। 'নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ' নামে খ্যাত মালদ্বীপে গিয়ে মনে হয়েছিল আমার দাদার বাড়ির সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে। যদিও জন্মটা হাওরের ভেতরে নয় পাড়ে, তথাপি সেই শৈশব থেকেই হাওরের মাটিতে লড়াই করে বড় হয়েছি। দেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ সেই জনপদে শিক্ষা পাওয়াটি ছিল অসম্ভব এক কাজ। বাড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের এক হাইস্কুলে বোর্ডিংয়ে থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি আর সেই হাইস্কুল থেকে ৪৮ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছি। তখন সেই অঞ্চলে কলেজে পড়ার কোন সুযোগই ছিল না। বাধ্য হয়েই চলে এসেছিলাম ঢাকা। আমার পথ ধরে আমার পরিবারের প্রায় সবাই এবং এলাকার অনেক মানুষ এখন নগরবাসী।
তবে এখনও আমার রক্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানুষেরা হাওরে অমানবিক আদিবাসী জীবনযাপন করে। গত আধা শতাব্দীতে নিজেরা যুদ্ধ করে এর অবস্থা অনেকটা বদলাতে পারলেও একুশ শতকের সভ্যতার স্পর্শ থেকে অনেক দূরে, পরম প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে ওরা। অথচ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই এলাকাটির উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে অনেক। সেই জনপদ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামটা করে আসছি আজন্ম। একটি নীতিমালা বা পরিকল্পনার ছকে যাতে সেই অঞ্চলটিকে দেশের অন্যতম একটি সেরা জনপদে পরিণত করা যায় সেই চেষ্টাও করছি। দেশের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বছরের পর বছর হাওরের কথা বলে আসছি। বেঁচে থাকার শেষ সময় পর্যন্ত এই লড়াই অব্যাহত থাকবে।
গত কয়েক বছর ধরে হাওরের সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে নিজে অনেক কথা বলেছি, হাওরের মানুষ অনেক কথা বলেছে এবং এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞরাও অনেক কথা বলেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, সরকার হাওর নিয়ে একটি কর্ম পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর একটি মহাপরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে।
আমরাও হাওরের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অন্যরাও বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরেছেন। হাওরের সমস্যাগুলো পুরনো এবং স্বতসিদ্ধ। ওই এলাকায় বসবাস করেন এমন প্রতিটি মানুষ অবলীলায় তার সংকটগুলোর কথা বলতে পারবেন। সমস্যার আকারও অনেক বড়। অনেক বড় ধরনের প্রকল্প, পরিকল্পনা বা সদিচ্ছা ছাড়া এসব সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা যাবে না। ছোটখাটো উদ্যোগ নিয়ে কোন কোন সমস্যার আপাত সমাধান করা গেলেও প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী ও কমিটেড উদ্যোগ। সবগুলো সমস্যার সমাধান একসঙ্গে হয়তো করা যাবে না। কিন্তু কিছু কিছু কাজ খুব সহজেই করে ফেলা যাবে।
আমার কাছে মনে হয়, কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এই অগ্রাধিকারগুলো বিবেচনায় নিলে হাওরবাসীর প্রতি সুবিচার করা হবে অন্যথায় নয়।
ক) কৃষি : আমি চিহ্নিত করেছি হাওরের মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম প্রধান সংকট হলো কৃষিভিত্তিক। পুরো হাওরজুড়ে ধানের উৎপাদন হয় বলে ধানের আবাদ করা ও ধান রক্ষা করার সঙ্গে কৃষক যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থেই করতে হবে। ধান উৎপাদিত হলে লাভ কেবল কৃষকের নয়, পুরো জাতির। ফলে হাওরের কৃষকের জন্য সার বীজ জোগান দিলে লাভটা জাতির। ধান নষ্ট হলে ক্ষতি কেবল ওই এলাকার কৃষকের নয় পুরো জাতির। ফলে ধান রক্ষা করার কাজটি জাতীয় স্বার্থেই করতে হবে। তবে সেই এলাকার কৃষকের জীবন রক্ষার জন্য দাদন বন্ধ করে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
খ) যোগাযোগ : হাওরের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন একটি অগ্রাধিকারের বিষয়। হাওরের উত্তর দিয়ে খাসিয়া গারো পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক তৈরি করা হলে হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি বড় বিপ্লব সাধিত হবে। হাওরের মাঝখান দিয়ে সড়ক নির্মাণ সম্ভব নয় বলে হাওরের প্রবেশদ্বার যেমন, নিকলী, বাজিতপুর, চামড়া ঘাট, উচিতপুর, বোয়ালি, শ্যামারচর, লাখাই ইত্যাদি স্থান পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কের উন্নয়ন করা যেতে পারে। এগুলো মহাসড়ক হলে হাওরের মানুষের যাতায়াতের সংকট অনেকটাই লাঘব হবে। অন্যদিকে হাওরের ভেতরের বিল-খাল ও নদী খনন করতে হবে এবং স্থানে স্থানে বাঁক সোজা করতে হবে।
গ) জলমহাল : হাওরের জলমহালগুলোর ইজারা বন্ধ করতে হবে এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় অভয়ারণ্য তৈরিসহ হাওরের মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। পুরো হাওর অঞ্চলটিকে একটি সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে।
ঘ) শিক্ষা : হাওরের শিক্ষার বিস্তারে প্রতি গ্রামে বা প্রতি পাড়ায়, পাড়া কেন্দ্র বা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতি ইউনিয়নে অন্তত একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকতে হবে। প্রতি থানায় কমপক্ষে ৩টি কলেজ থাকতে হবে যার একটিতে স্নাতকোত্তর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। প্রতি থানায় একটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। হাওরের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের আউটসোর্সিং কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত করে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করতে হবে।
ঙ) স্বাস্থ্য : হাওর অঞ্চলে প্রতি ইউনিয়নে অন্তত একটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও নৌ ম্বুলেন্স, ভাসমান হাসপাতাল ও টেলিমেডিসিন সেবা চালু করতে হবে।
চ) বাড়ি রক্ষা : হাওরের বাড়িঘর, স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রামের সামনে ঢেউয়ের আঘাত যেদিক থেকে লাগে সেদিকে মজবুত পাকা দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।
আমি মনে করি ছয়টি বড় দাবির বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত ছোট ছোট বা আরও অপরিহার্য বিষয়গুলোর কথা ভাবা যাবে।
ছ) প্রকৃতি ও পরিবেশ : হাওরের মানুষ ও প্রকৃতি কেবল বিদ্যমান বা অভ্যন্তরীণ সংকটেই বিপন্ন নয়। ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ থেকে শুরু করে, সারি নদীর প্রস্তাবিত বাঁধ ও চীন-নেপালের বহুমুখী বাঁধসহ নানাবিধ কর্মকা- হাওর এলাকার মানুষ ও প্রকৃতিকে বিপন্ন করছে। এই এলাকার জন্য বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতাও একটি বড় ধরনের বিপদ তৈরি করেছে। রাষ্ট্রকে এসব সংকট থেকে হাওর এলাকা, তার মানুষ ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে।
একই সঙ্গে এই বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার যে হাওর নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বা জাতীয় জীবনে গুরুত্ব কেন দিতে হবে। আমি সবচেয়ে জরুরি কয়েকটি বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
ক) হাওর অঞ্চল বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বসতিপূর্ণ অঞ্চল। ওখানে প্রচুর পরিমাণ জমি রয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বসবাসযোগ্য বা চাষযোগ্য জমি শেষ হয়ে গেলে হাওর এলাকাই হবে আমাদের জাতীয় জীবনের শেষ ভরসা। ওটি বসবাসযোগ্য না হলেও বাধ্য হয়েই হয়তো পানির ওপরে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের বাস করতে হবে। ওখান থেকেই আনতে হবে আমাদের খাদ্য।
খ) অঞ্চলটি কেবল বাংলাদেশের নয় সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিষ্টি পানির অস্থায়ী আধার। আমাদের এই পানি ব্যবহার করতে হবে।
গ) হাওরের পাড়ে অনেকগুলো গ্যাসফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। সুনেত্র হলো এর সর্বশেষটি। সম্ভাবনা হলো যে হাওরের ভেতরেও তেমন গ্যাসক্ষেত্র বা অন্য প্রাকৃতিক সম্পদ থাকতে পারে। জাতীয় স্বার্থেই সেসব সম্পদ রক্ষা ও আহরণ করতে হবে। হাওরের একেবারে উজানে যে বিপুল পরিমাণ পাথর জমা হয় সেটি হাওরের নদীগুলো দিয়েই বহন করা হয়। নদীপথের উন্নয়ন যেমন করে দেশের অবকাঠামো গড়ে তোলার অতি প্রয়োজনীয় এসব কাঁচামাল পরিবহনে সহায়তা করবে তেমনি হাওরের ওজানের সড়কপথ আরও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
সার্বিকভাবে এই কথাটি বলা যায় যে হাওরের প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেবলমাত্র একতরফাভাবেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না। বস্তুত হাওরের মানুষের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও এই রাষ্ট্র হাওরের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে নিজে লাভবান হবে।
যদিও খুব সাম্প্রতিককালে হাওর এলকার উন্নয়ন ও সংকট মোকাবিলা নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা বেড়েছে এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে বিষয়টি যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে তবুও হাওর অঞ্চলের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সেই এলাকার মানুষও তাদের প্রতিনিধিদের মাঝে সেই পর্যায়ের কর্মকা- নেই যতটা থাকা উচিত। আমি আশা করব যে, এটি দিন দিন বাড়বে এবং বিশেষ করে হাওরের অধিবাসীরা তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আরও সচেতনভাবে সক্রিয় হবেন।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কি-বোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা]
ই-মেইল - mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ - www.bijoyekushe.net